বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আপনি হারেননি, হেরেছে বাংলার বেকার যুবক – যুবতীরা

152

বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?

ব্রাউন ব্রেড, বাটার, এগ হোয়াইট আর মিক্সড ফ্রুট জুইস সহ ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করার সময় ইকোনমিক টাইমস পড়তে পড়তে পেশাতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আমার বন্ধু বলে ওঠে – “৩৪ বছরে বামেরা কিছুই করেনি”। আমার বন্ধু সল্টলেক টেকনোপলিসের কগনিজেন্ট এর অফিসে চাকরি করে। মাস গেলে বেশ মোটা অঙ্কের বেতন, শহরের বুকে ৩ বিএইচকে ফ্ল্যাটে অত্যাধুনিক ফার্নিচার, দামি গাড়ি চেপে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে কে নিয়ে সপ্তাহান্তে অন্তত একবার আইনক্স-এ সিনেমা দেখে ফেরার পথে ম্যাকডোনাল্ড-এ ঢুঁ মারা আর বাড়ি ফিরে এসে হালকা করে এসি-টা ছেড়ে দিয়ে দামি সোফায় বসে বিশাল বড় এলসিডি টিভির সামনে বসে কমিউনিস্ট দের সমালোচনা করে গুষ্টি উদ্ধার না করলে পেটের ভাতটা ঠিক হজম হয় না, রাতের ঘুমটা ঠিক গাঢ় হয় না, মনের কোণে ঠিক একটা আত্মতৃপ্তির পূর্ণতা মেলে না। এই তো জীবন কালিদা, সকাল বিকেল কমিউনিস্টদের সমালোচনা করে পাড়া মাথায় না তুললে ও জিন্দেগী জিন্দেগী নেহি হ্যা কালিবাবু, ও কুচ ওর ই হ্যা।
হাওড়া থেকে হনুলুলু, নেটফ্লিক্স থেকে নিমাই-এর চায়ের দোকান, ডালগোনা কফি থেকে শুরু করে মুসুর ডালের দাম সবকিছুই নখদর্পনে রাখলেও আমার বন্ধু শুধু জানেনা ২০০০ সালের ২৬ নভেম্বর সল্টলেকে দ্বিতীয় টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধন হোক বা ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর মহাকরণে আইবিএম-এর সাথে চুক্তি সম্পাদন হোক অথবা ২০০২ সালের ২৬ জুন উইপ্রোর চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজির সাথে চুক্তি সাক্ষর কিম্বা ২০০৩ সালের ১১ জুলাই বিধাননগরে কগনিজেন্ট টেকনোলজি সলিউনের নতুন কমপ্লেক্সের উদ্বোধন অথবা বা ওই একই বছরের ৯ অক্টোবর রাজারহাটে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক ও পরিকাঠামো গড়তে মহাকরণে চুক্তি-সই কিম্বা বা ২০০৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মহাকরণে আইবিএম-এর প্রতিনিধিকে রাজি করিয়ে রাজ্যে আরো একটি আইবিএম-এর অফিস খুলতে চুক্তি সাক্ষর বা ঠিক তার পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যামাক স্ট্রিটে তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরের অফিস উদ্বোধন বা ওই বছরের ১৯ নভেম্বর বিধাননগরে উইপ্রোর কলকাতা ডেভেলপমেন্ট সেন্টার উদ্বোধন করার সময় উইপ্রোর চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি এর সাথে চুক্তি সাক্ষর করা যে রাজ্যে উইপ্রোর আরো বিনোয়োগ হবে অথবা বা ওই একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রিন আই পার্ক টেকনোপোলিস এর উদ্বোধন বা ২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নোনাডাঙায় আইটি পার্কের শিলান্যাস -এই সবকিছুই ওই একটা ৩৪ বছরের সরকারের আমলেই হয়েছিল ওই একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামক মানুষের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই হয়েছিল।
২০০৫-০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে রপ্তানি বাবদ পশ্চিমবঙ্গ আয় করেছিল ২৭০০ কোটি টাকা যা সপ্তম বামফ্রন্ট এর শেষের দিকে গিয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬,৪০০ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে তথ্য প্রযুক্তি তে কাজ করতেন ৩২ হাজার মানুষ তা মাত্র ৩ বছরের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ। অনুমান ছিল পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে ওই সংখ্যাটি কয়েক লক্ষ হবে। আর এসবই হয়েছিল ওই বুদ্ধবাবুর আমলে একটা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। যদিও আমার বন্ধু এসব খবর রাখেনা,আমার বন্ধু তো এটাও জানেনা বামফ্রন্ট আমলে চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর পরিবর্তনের নতুন বাংলা তে জমি না পেয়ে ইনফোসিস কে আমাদের রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল অথচ ইনফোসিস এর ওই অফিস টি হলে সরাসরি ১০ হাজার আই টি কর্মী চাকরি পেতেন।

বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?

আমার দাদা স্কুল শিক্ষক। আমার দাদা বাসে-ট্রেনে-ট্রামে-পাড়ার পচাদার চায়ের দোকানে এমনকি বিয়ে বাড়িতে গিয়েও সুযোগ পেলে মানুষজন দের শুনিয়ে দিয়ে আসে- “৩৪ বছরে বামেরা কিছুই করেনি”। বামফ্রন্ট আমলে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাতে কঠোর পরিশ্রম করে রাতদিন পড়াশোনা করে ওই একটা স্কুল সার্ভিস কমিশন এর পরীক্ষাতে পাশ করার পর স্কুল শিক্ষকের চাকরি পাওয়া আমার দাদা হার্দিক পান্ডিয়ার গার্ল ফ্রেন্ড থেকে আমাজন প্রাইম এর ওয়েব সিরিজ, তৈমুরের সারাদিনে প্যান্ট পাল্টানো থেকে গরুর দুধে সোনা পাওয়ার পিএইচডিডি থিসিস সবকিছুর খবর নখদর্পনে রাখলেও শুধু এটুকু খবর রাখেনা যে ১৯৯৮ থেকে ২০১০, আমাদের রাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি’র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল ১,৮৫,৮৪৫ জন। গড়ে ১৫ হাজারের মতো ইতিহাস-ভূগোল-বাংলা-ইংলিশ-ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি তে স্নাতক করা ছেলে মেয়েদের প্রতি বছর শিক্ষক শিক্ষিকা হওয়ার সুযোগ মিলতো। পরিবর্তনের ঠেলায় শেষ ৯ বছরে আপনার এলাকা থেকে কতজন ছেলেমেয়ের এস.এস.সি’র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে ? পরিবর্তনের ঠেলায় আজকে কলকাতার রাজপথের খোলা আকাশের নিচে এসএসসি’র দাবিতে নামের পাশে স্নাতক ও বি এড ডিগ্রী নিয়ে শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের প্রায় এক মাস ধরে অনশন করতে হয় বা চাকরির জন্য ১০ লাখ টাকা রেডি রাখতে হয়। কলেজ পাস করা ২ টো প্রজন্মের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত খুব ঠান্ডা মাথায় খুন হয়ে গেলো ,দিনে ২ জিবি করে নেট ব্যবহার করা তরুণ-তরুণী প্রজন্মের কেউ ঘুণাক্ষরে টের-‘ও পেলোনা।

বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?

সিঙ্গুরের কারখানা’টা করতে না দিয়ে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার সহ শিক্ষিত যুবক যুবতীর কবরের মাটি সেদিন এই বাংলার বুকে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলো। এ রাজ্যের মানুষ হয়তো আপনাকে চিনতে পারেনি কিন্তু আমি নিশ্চিত জীবনের কোনো এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সে শ্রমিক হোক বা কৃষক, মাননীয়ার প্ররোচনায় পা দিয়ে সিঙ্গুরের ওই অনিচ্ছুক কৃষক হোক বা ধর্মের নামে ভুলে থাকা ওই যুবক, জীবিকার প্রয়োজনে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া ওই ছেলেটি হোক বা রাতদিন আপনার সমালোচনা করে পাড়া মাথায় তোলা ওই মেয়েটি, স্নাতক ও বিএড করার পর ও শিক্ষকতা’র চাকরি করতে না পেরে পেট চালানোর দায়ে কারখানায় ৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করা ওই ছেলেটি হোক বা ঘুষ দিতে না পেরে প্রাইমারী স্কুলের প্যানেল থেকে শেষ মুহূর্তে নাম বাদ পড়ে যাওয়া ওই মেয়েটি আপনার অভাব একদিন ঠিক বুঝবে, আর যেদিন বুঝবে ঠিক সেদিন ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক ভীষণ রাগে যুদ্ধের পর বাতাসে বারুদের গন্ধ মিলিয়ে গিয়ে আবার বসন্ত আসবে।

আসলে বামেদের পরাজয়ে সেদিন কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হারেননি, হেরেছিল তো আমরা বাংলার মানুষরা। হেরেছিল তো বাংলার লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক যুবতীরা।

©— সৌ তি ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × 1 =