মুকুল রায় নামটা শুনলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সচেতন মানুষের চোখে প্রথমেই যাঁর ছবি ভেসে ওঠে, তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধান পরামর্শদাতা এবং আধুনিক রাজনীতির জনক চাণক্য |
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই চাণক্যের মতোই নিশ্চুপে শীতল মস্তিষ্কে রাজনৈতিক অপারেশন চালানোর কৌশল এখনও অব্দি এই সময়ে মুকুল রায় ছাড়া কেউই রপ্ত করতে পারেননি | বলা যায়, বামফ্রন্ট আমলের অনিল বিশ্বাস বা কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীকেও রাজনৈতিক কৌশলের মুন্সিয়ানায় টপকে গেছেন মুকুল রায়।
উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়ার এক মধ্যবিত্ত সাধারণ পরিবারে ১৯৫৪ সালে জন্ম হয় মুকুলবাবুর | ২০০৬ সালে রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে ২০১২ সালে ভারত সরকারের রেলমন্ত্রী হওয়ার জার্নিটা খুব একটা সহজ ছিল না।
১৯৯৮ সালে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৃণমুল কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর থেকেই অসম্ভব পরিশ্রমী ক্ষুরধার মস্তিস্কের মুকুল রায় হয়ে উঠেছিলেন পার্টির অন্যতম চালিকাশক্তি |আগাগোড়া প্রচারবিমুখ মুকুল রায় জানতেন, ব্যক্তিগত প্রচার নয়, কর্মীদের মধ্যে সংযোগস্থাপনই তাঁকে অপরিহার্য করে তুলতে পারে |
আর হয়েছিলও ঠিক তাই | কাকদ্বীপ থেকে আলিপুরদুয়ার অবধি কর্মীদের মধ্যে অনায়াস সংযোগস্থাপনই তাঁকে দলের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় | আর দেখা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন দলের মুখ আর মুকুল রায় ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন দলের অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক।
২০০৬ সালে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর আর ঘুরে তাকাতে হয়নি তাঁকে |সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় সংযোগস্থাপনের কাজটি সূচারুভাবে করতেন মুকুল রায় | একদিকে দিল্লির রাজনীতিকদের বাংলার তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য যোগানো অন্যদিকে বাংলার বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে দলের যোগসূত্র বজায় রাখতেন তিনি। ২০০৯ সালে কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাহাজ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় তাঁকে।
২০১১ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর তিনি দলের অভ্যন্তরে হয়ে ওঠেন অবিসংবাদী মুখ |;কলেজ জীবনে ভালো ক্রিকেটার মুকুল রায় স্টেপ আউট করে দলের মধ্যে তাঁর সব নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীদের শুধুমাত্র কমিটমেন্টের নিরিখে মাঠের বাইরে ফেলে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দলের সর্বস্বীকৃত দুই নম্বর ব্যক্তিত্ব। ২০১১ সালে রেলমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে ২০১২ সালে ছয় মাসের জন্য রেলের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও ম্যাচিওরড পলিটিশিয়ানে রূপান্তরিত করে।
২০১২ সালে তৃণমূল কংগ্রেস FDI ইস্যুতে ইউপিএ সরকার থেকে বেরিয়ে আসার পর মুকুলবাবু পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন দলীয় রাজনীতিতে। মূলত তাঁর হাত ধরেই ২০১২ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে তৃণমূল ত্রিপুরা,মণিপুর এবং অরুণাচল প্রদেশে শাখা বিস্তার করে।
এরপর ২০১৩ সালে সারদা বিতর্ক এবং ২০১৬ সালে নারদা বিতর্ক মুকুল রায়কে কিছুটা বিব্রত করলেও খুব বেশি বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পুনরায় তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন মুকুল রায় | গুরুত্ব বাড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির | তিনি হয়ে ওঠেন দলের দুই নম্বর মুখ। প্রায় নিজের হাতে তৈরি দলের এই উপেক্ষা সহ্য করতে পারেননি বর্ষীয়ান পোড় খাওয়া রাজনীতিক মুকুল রায় | তাই বাধ্য হয়ে ২০১৭ সালে তিনি যোগ দেন ভারতীয় জনতা পার্টিতে।
মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আশাতীত সাফল্য পেয়েছে। বাংলার মানুষ শাসকদলের বিরুদ্ধে বিরোধিতার মুখ হিসাবে বেছে নিয়েছে বিজেপিকে।
এই লকডাউন মধ্যবর্তী অবস্থাতেও নিরন্তর টেলিফোনে মানুষের সঙ্গে সংযোগরক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অনুগামীদের প্রিয় মুকুলদা।
প্রতিদিন কাঁচরাপাড়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সল্টলেকে তাঁর অস্থায়ী ঠিকানার অফিসে বসে সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা কর্মীদের খোঁজ রাখছেন,প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অবিরত। দৈনিক ১৮ ঘন্টা পরিশ্রমে অভ্যস্ত এবং নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়া ৬৬ বছরের যুবক মুকুল রায়ের জীবনের গতি এই লকডাউনও শ্লথ করতে পারেনি | কারণ মিতভাষী স্বল্পাহারী মুকুল’দা জানেন, এই পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও গতিময়তাই তাঁর জীবনে সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।
ভালো থাকবেন মুকুল’দা,আপনার দীর্ঘ সুস্থ রাজনৈতিক জীবন কামনা করি 🙏🙏
দীপ্তিমান বসু
৫/৫/২০২০